গতকাল বেলা ১১টার পর সদর উপজেলার জয়নাল হাজারী কলেজের গেটের সামনে উঁচু যাত্রীছাউনিতে কথা হয় বৃদ্ধা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, বুধবার আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় দুটি গরু পাশের বাড়ির খামারে বেঁধে রেখে এসেছিলেন। শেষ সম্বল গরুর দেখাশোনা করতে হাজারী কলেজের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সাঁতরে মূল সড়কে আসেন নূরজাহান। রাস্তায় এসে নৌকা না পাওয়ায় অগত্যা ঠায় বসে থাকেন তিনি।
সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। তিনি বলেন, নৌকা সমস্যার কারণে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। পানি কমায় এখন মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে।
টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে গত মঙ্গলবার থেকে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া এলাকা প্লাবিত হয়। এরপর ফেনী শহর ও সদর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন জেলাবাসী। শুক্রবার থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি কমতে থাকলেও বাড়ে সোনাগাজী উপজেলায়। এতে বেশির ভাগ মানুষ আশপাশের বহুতল ভবন, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-মসজিদে আশ্রয় নেন।
সোনাগাজী এলাকার বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার পর লালপোল থেকে সোনাগাজীর সড়ক ধরে হাঁটতে থাকেন এ প্রতিবেদক। পুরো সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কোমরপানি ছিল। এ সময় তিন ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের মতো গোবিন্দপুর, নতুন বাজার, বালুয়া চৌমুহনী এলাকায় যান তিনি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবীদের কয়েকটি দলকে ট্রাক ও নৌকায় করে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়। তবে এই কয়েক ঘণ্টায় চোখে পড়েনি সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম।
জাহেদা আক্তার নামের এক নারী জানান, তাঁরা একসঙ্গে আটটি পরিবার আছে। বন্যার কারণে চাপকল থেকে পানি নিতে পারছেন না। জাহেদা আক্তার বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আট পরিবারের মানুষ। শুকনা খাবার থাইকলেও হানির কষ্টে আছি। হানি না হাইলে বন্যার হানি খাইতে হইব। হেট খারাপ হইলেও কিচ্ছু করার নেই।’
বালুয়া চৌমুহনী এলাকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা ছারোয়ার আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, নিজের টিনের ঘর ডুবে যাওয়ায় পাশের বাড়ির বহুতল ভবনের দোতলায় উঠেছেন। গ্রামের ভেতরে বাড়ি হওয়ায় ত্রাণ দিতে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছারোয়ার আলম বলেন, ‘তিন দিন ধরে আরেকজনের বাইত আশ্রয় লইছি। মাইষে কইতেছে ত্রাণটান দিচ্ছে; কিন্তু চোখে দেখিনি। সরকারি রিলিফও পায় নাই।’
চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকা থেকে আগত ত্রাণবাহী একটি ট্রাকে করে বালুয়া চৌমুহনী এলাকায় এক কিলোমিটারের মতো ছিলেন এ প্রতিবেদক। সেখানে বেশির ভাগ মানুষকেই খাবারের পানি চাইতে দেখা যায়। ত্রাণের ট্রাক দেখলে আশপাশের ভবন থেকে পানি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে দেখা যায় মহিলাদের।
সরকারি ত্রাণ তেমন পাচ্ছে না, কিংবা সরকারের কাউকে দেখেনি এমন অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বলেন, সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে—একই সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগেও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
বালুয়া চৌমুহনী এলাকায় কথা হয় জয়নাল হাজারী কলেজের ডিগ্রিপড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, মুরব্বিরা বলছেন তাঁদের জীবনে এমন বন্যা দেখেননি। বন্যার অভিজ্ঞতা থাকলে প্রস্তুতি নেওয়া যেত। অপ্রস্তুত থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজে অংশ নিতে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে অনেকেই আসছেন দুর্যোগপূর্ণ এলাকায়। অনেক স্বেচ্ছাসেবী থাকলেও সরেজমিনে কিছু ক্ষেত্রে সমন্বয়নহীনতা লক্ষ করা গেছে। লালপোল থেকে সোনাগাজীর রাস্তায় একাধিক নৌকা ও স্পিডবোট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দুটি নৌকার স্বেচ্ছাসেবকেরা জানিয়েছেন, মাঝি না থাকায় তাঁরা চালাতে পারছেন না। একই কারণে দুটি নৌকা ট্রাক থেকেও নামানো হয়নি। কীভাবে এই নৌকা ট্রাক থেকে নামানো হবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাঁদের।
ফেনী জেলার জয়নাল হাজারী কলেজের সামনে একটি নৌকা ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মাঝি না থাকার কারণে কীভাবে তাঁরা ত্রাণ নিয়ে যাবেন, তা জানেন না। এ সময় পাশে দাঁড়ানো আরেকটি নৌকাকে তাঁদের মাঝি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে দেখা যায়।
বন্যার কারণে ফেনী শহরের সঙ্গে কয়েক দিন ধরে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন বাকি উপজেলাগুলোর। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের কারণে স্থানীয়রাও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। এ কারণে চলমান বন্যায় কী পরিমাণে ফেনীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে তথ্য এখনো সরকার দিতে পারছে না বলে জানা গেছে প্রশাসন সূত্রে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার দিনের বন্যায় যাঁরা যাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ে গেছেন, শুক্রবার থেকে তাঁদের মধ্যে খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস থাকলেও পুলিশ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ফেনীর নেটওয়ার্ক ডিসকানেকটেড। অতটা খবর আমার কাছেও নেই। আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মিরসরাইয়ের পর আর যেতে পারিনি। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, আস্তে আস্তে পানি কমতেছে। বিশেষ করে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার পানি কমতেছে। ওইদিকে সোনাগাজীর দিকে পানি বাড়তেছে।’
এখন পর্যন্ত ফেনীতে দুজন মারা গেছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ গতকাল পানিতে পড়ে ১ বছর বয়সী এক মেয়েশিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন সূত্র। বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘আমাদের কাছে দুজন মারা যাওয়ার তথ্য আছে। পানি কমলে এবং নেটওয়ার্ক সচল হলে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে।’