গত ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এরপর তারা মুক্তিপণ দাবি করে। দীর্ঘ এক মাস পর মুক্তিপণ পেয়ে ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজকে মুক্ত দিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
বাংলাদেশ সময় শনিবার রাতে নয়টি বোটে করে একে একে ৬৫ জন জলদস্যু এমভি আবদুল্লাহ থেকে চলে যায় রাতের আঁধারে। যাবার আগে নাবিকদের উদ্দেশ্যে বলে যায়, ‘তোমরা এখন মুক্ত’।
এর পরপরই এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন দেশে জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে তাদের মুক্তির বার্তা পাঠান।
রোববার দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদে কবির গ্রুপের কার্যালয়ে এসআর শিপিং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাবিকদের মুক্তির মুহূর্তের এমন বর্ণনা দেন কোম্পানির সিইও মেহেরুল করিম।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে সব কাজ লিগ্যালি আমরা শেষ করেছি। রাত ৩টার দিকে মেসেজ আসে, ক্যাপ্টেন জানায় তারা মুক্ত। ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজে ছিল। তারা নয়টি বোটে করে চলে যায়। যাবার সময় তারা বলে যায়, ‘তোমরা এখন মুক্ত’।
এদিকে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের মুক্তির আগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
দিনের বেলার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুল্লাহর নাবিকরা সবাই জাহাজের ডেকে লাইন ধরে দাঁড়ানো। ছোট আকারের একটি উড়োজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সামনে চক্কর দিচ্ছে।
ওই সময় জলদস্যুরা দুটি স্পিড বোট নিয়ে জাহাজের সামনে অবস্থান নেয়। জাহাজে থাকা একজন বাংলায় নাবিকদের হাত তুলতে বলেন। এরপর সোমালি ভাষায় জলদস্যুরা কিছু বলতে শোনা যায়।
উড়োজাহাজটি একবার চক্কর দিয়ে একটি করে ব্যাগ পানিতে ফেলছিল। তারপর স্পিড বোটে থাকা জলদস্যুরা সেই ব্যাগটি তুলে নিচ্ছিল। এভাবে তিনবার তিনটি ব্যাগ ফেলা হয়। প্রতিবারই জলদস্যুরা উল্লাস করছিল।
তৃতীয় ব্যাগ ফেলার পর উড়োজাহাজটি ঘুরে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। এরপর এমভি আবদুল্লাহতে থাকা কেউ একজন ইংরেজিতে নাবিকদের বলেন, ‘তোমরা এবার মুক্ত। এখন চলে যেতে পারবে।’
বাংলাদেশে তখন শনিবার রাত ৩টা; ওই সময়ই মুক্তি পায় জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং এর ২৩ নাবিক।
বাংলাদেশ সরকার কিংবা জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কেউ মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি। নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, মুক্তিপণ দেওয়ার কোনো তথ্য ‘সরকারের কাছে নেই’।
জাহাজ ছিনতাইয়ের পর থেকে দস্যুদের মুক্তিপণের বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে জলদস্যুরা মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও করে। কিন্তু নাবিকদের ছাড়াতে মুক্তিপণ লেগেছে কি না, কিংবা কী পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তারা ছাড়া পেয়েছেন, সে সম্পর্কে সরকার কিংবা জাহাজের মালিকপক্ষের কেউ কথা বলেননি।
তবে নাবিকদের মুক্তির কয়েক ঘণ্টা পর দুজন জলদস্যুর বরাতে ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণের কথা লিখেছে রয়টার্স। সোমালিয়ার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোও একই পরিমাণ মুক্তিপণের খবর দিয়েছে।
মুক্তিপণের বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি মেহেরুল করিম।
তিনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোমালিয়া এমনকি কেনিয়ার মেরিটাইম আইন মেনে কাজ করেছি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করেছি। সমঝোতার শর্ত অনুসারে অনেক বিষয় প্রকাশ করতে পারব না আমরা।’
১৪ বছর আগে ২০১০ সালে একই গ্রুপের জাহাজ এমভি জাহান মণি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই জাহাজ মুক্ত করার কাজে মালিকপক্ষে ‘সমঝোতাকারী’ হিসেবে যুক্ত ছিলেন মেহেরুল করিম। সেবারের মতো এবারো জলদস্যুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিকপক্ষের হয়ে যোগাযোগ রাখছিলেন তিনি।
এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত করার প্রক্রিয়া জানিয়ে মেহেরুল করিম বলেন, জাহান মণি যখন জিম্মি হয়, তখন আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। সেবার ১০০ দিন লেগেছিল জাহাজ মুক্ত করতে।
তিনি আরও বলেন, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এমভি আবদুল্লাহর ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পেরেছি। জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে শুরু করে জাহাজ উপকূলে নিয়ে যাওয়া এবং এরপর শেষ পর্যন্ত মনিটর করেছি।’
জলদস্যু দলের কমান্ডারদের মধ্যে একজনের সহকারী ইংরেজি জানতেন এবং তার সঙ্গে কথাবার্তা হত বলে জানান মেহেরুল করিম।
মেহেরুল করিম বলেন, ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হত। ৩০ দিনই যোগাযোগ রেখেছি। জলদস্যুদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন হওয়ার পর আমাদের একটি চাহিদা ছিল। সেটা হলো প্রত্যেক ক্রু কেমন আছে, সেটা ভিডিও করিয়েছি। তারপর আমরা নিশ্চিত হই, সবাই সুস্থ আছে।
সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ রোববার রাত ৩টার দিকে মুক্তি পায় জলদস্যুদের হাত থেকে।
মুক্তির পর এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি সোমালিয়া থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করেছে বলে মালিকপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে।
গত ১২ মার্চ দুপুরে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের কবির গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল জাহাজটি। জিম্মি ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি।
অস্ত্রের মুখে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সোমালি উপকূলে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। সেখানে পৌঁছানোর পর বারবার জাহাজের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়। ছিনতাইয়ের ৯ দিনের মাথায় জলদস্যুদের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় জাহাজের মালিকপক্ষের।
মুক্তিপণ নিয়ে দেন দরবারের পর অবশেষে জাহাজটি দস্যুমুক্ত হল এক মাস পর।